উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ধীরগতিসহ সার্বিকভাবে অর্থ ব্যয় সেভাবে না হওয়ায় সরকারের ঋণ গ্রহণ কমছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাজেটের ৫৬ শতাংশ (৩ লাখ ৩০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা) অর্থই ব্যয় হয়নি। ফলে সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক ও বৈদেশিক খাত থেকে এই সময়ে ঋণ নিতে হয়েছে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা।

যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। খরচ কম হওয়ায় ক্ষেত্রবিশেষ বকেয়া ঋণও পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়নের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। কম ঋণ গ্রহণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, প্রয়োজন না হলে ঋণ নেওয়া হবে না।

তবে আমাদের একটি কালচার অর্থবছরের শেষ তিন মাসে টাকা খরচ বেড়ে যায়। আমার ধারণা শেষ তিন মাসে টাকা খরচ বাড়লে ঋণের অঙ্কও বাড়বে। তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে প্রতিদিনই ঋণ নেওয়া হয়। আর বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয় প্রকল্পের অনুকূলে। যেহেতু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হার কম, সে জন্য বৈদেশিক ঋণের ব্যবহারও কমেছে।

প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত (৯ মাসে) ঋণ নেওয়া হয়েছে ২৯ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। এ খাতে বছরের শুরুতে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয় ৮৭ হাজার কোটি টাকা।

একই সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। এ খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে জুলাই-মার্চ পর্যন্ত নিট ঋণ নেওয়া হয় ১৪ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। যদিও ঋণের লক্ষ্যমাত্রা আছে ৭৭ হাজার ২০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, কয়েকটি কারণে এ বছর টাকা ব্যয় কমছে। ফলে কমছে ঋণ গ্রহণের অঙ্কও। এছাড়া করোনার কারণে অনেক বিদেশি ঋণও পাওয়া গেছে। ফলে বাজেটের ঘাটতি পূরণে বিদেশি ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও কম দেখা গেছে।

এ বছর মেগা প্রকল্পের বাইরে আপাতত তেমন কোনো উন্নয়ন কাজ হচ্ছে না। যে কারণে অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার ৫৫ শতাংশ হয়েছে। এ বছর অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার। ফলে ব্যয়ের যে লক্ষ্য ধরা হয়েছিল তার অর্ধেকও হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে জুলাই-মার্চ পর্যন্ত ব্যয় করা গেছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা।

এটি মোট বাজেটের ৪৪ শতাংশ। ওই হিসাবে বাজেটের টাকা খরচের বাকি আরও ৩ লাখ ৩০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। যা ৩ মাসে ব্যয় করতে হবে। ফলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্থ খরচ সম্ভব হয়নি। যে কারণে ঋণের প্রয়োজনীয়তা কমছে। টাকা খরচের মধ্যে সরকারের পরিচালনা ব্যয় খাতে গেছে, ১ লাখ ৯৪ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। যদিও এক্ষেত্রে খরচের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে এ খাতে অবশিষ্ট আছে ১ লাখ ২৭ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। যা ৩ মাসের মধ্যে ব্যয় করতে হবে। তবে পরিচালনা ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধে। সেখানে ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার ২০৪ কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মতে, সুদ পরিশোধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছে সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে। বিগত সময়ে অনেক ঋণ নেওয়া হয়েছে এ খাত থেকে। সেসব সুদও পরিশোধ করতে গিয়ে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে।

সূত্র জানায়, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে পর্যাপ্ত ঋণ পাওয়া গেছে। যা দিয়ে প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর পরও বেশ কিছু অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকছে। ঋণের বোঝা লাঘব করতে সেই অর্থ দিয়ে সরকার আগের ঋণ শোধ করছে।

অন্যদিকে রাজস্ব আদায় খুব বেশি ভালো না হলেও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। মার্চ পর্যন্ত মোট আয় হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি।

এসব কারণে ঋণ কম নেওয়ার পাশাপাশি বকেয়া ঋণ পরিশোধের সুযোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ১০ হাজার ৭২ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক ঋণ ২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।